Ads

পশ্চিমবঙ্গের কৃষক || Farmers of West Bengal || Indian peasants and West Bengal

                                      পশ্চিমবঙ্গের কৃষক

পশ্চিমবঙ্গের কৃষক || Farmers of West Bengal || Indian peasants and West Bengal


ভূমিকা :-
"যার ধন , তার নয়। যাহার মাথার কালঘাম ছুটিয়া ফসল জন্মে , লাভের ভাগে সে কেহ হইল না। "--- বঙ্কিমচন্দ্র।
একদিন পল্লীই ছিল ভারতে সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। পল্লীর  অঙ্গনেই প্রবাহিত হয়েছে বিচিত্র জীবন-স্রোত।
কৃষিই ছিল সেদিনের গ্রাম-ভারতে অর্থনৈতিক বনিয়াদি। কৃষকে আশ্রয় করেই ভারতবাসীর জীবন-জীবিকার উচ্ছল গতি-তরঙ্গ। বাংলাদেশের জীবনেও সেই প্রবাহেরই প্রাণ-স্পন্দন।  শুরু হল রাজা বদলের পালা।  হিন্দু রাজাদের দিন গেল।  এলো মুসলমান সুলতান বাদশার দল। 'মুসলমানদিগের সময়ে  প্রথম জমিদারের সৃষ্টি।' শুরু হল চরম দারিদ্র্য , উপেক্ষা আর পীড়ন।  মুসলমান শাসনও চিরস্থায়ী হল না। এলো ইংরেজ।  পত্তন হলো , আধুনিক কলকাতা শহরের।  গ্রাম পড়ে উপেক্ষার তিমিরে।  'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ' -র ফলে জমিদারের হাত হলো আরো বজ্র-কঠোর।  কৃষকের মুঠি থেকে জমির বাঁধন হলো শিথিল। দিন দিন ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা আরো বাড়াল।  ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষক হলো সর্বশান্ত।

প্রাক-স্বাধীনতা যুগে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক :-
'কৃষক বলিতে বাংলা দেশে এমন এক সম্প্রদায়কে বুঝায় যাঁহারা মূর্খ রোগক্লিষ্ট , পুরুষানুক্রমে ঋণভাৱে প্রপীড়িত ,আত্মোন্নতি সাধনের উপায় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অঞ্জ ,নিজের বাস-পল্লীর বাহিরে যে বৃহৎ পৃথিবী আছে।, তাহার কোনো সংবাদ যাঁহাদের নিকট পৌঁছে না। পরিধেয় তাঁহাদের ছিন্ন বসন , পানীয় তাঁহাদের পঙ্কিল দূষিত জল এবং বাসগৃহ তাঁহাদের ভগ্ন কুটির। ' এই হলো বাংলাদেশের কৃষিজীবী মানুষের চিরন্তন বেদনাবিধুর চিত্র। অবহেলা আর বঞ্চনার ইতিহাস।  তার ওপর জমিদারের খাজনা,মহাজনের করজ, দেড়া সুদ , নায়েবের পুণ্যাহের নজর , গোমস্তার সেলামি , পাইক-পিয়াদার পার্বণী দিতে দিতে তারা নিঃস্ব , কাঙাল। এ ছাড়াও আছে আরো নানা ধরনের জুলুম।  'পাট্টা' হারাবার ভয়ে নায়েব গোমস্তার বাড়িতে ওরা বেগার খাটে। 'কুমিরের সঙ্গে বাদ করিয়া জলে বাস চলে না।' তাই তাদের কন্ঠে নেই প্রতিবাদের ভাষা।  দেহে নেই শক্তি-সামর্থ্য। বরং আছে শত লাঞ্ছনার চিহ্ন।  আইন-আদালত তাদের কাছে প্রহসন। 'প্রতিবারে দুর্বল প্রজার বল হরণ করিয়া আইনকারক বলবান জমিদারের বল বৃদ্ধি করিয়াছেন।'

স্বাধীনোত্তর যুগে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক :-
ইংরেজ আমলে ভূমি-স্বত্ব ব্যবস্থা ছিল জমিদারী , মহালওয়ারি ও রায়তওয়ারি -- এই ত্রি-ধারায় বিভক্ত। দেশ স্বাধীন হলো। এলো দলে দলে শরণার্থী।  পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উৎপাদনে সৃষ্টি হলো এক সংকটাবস্থা। খাদ্য সমস্যা হলো তীব্রতর।  অর্থনীতির ক্ষেত্রেও স্পষ্ট হলো প্রাথমিক বিপর্যয়-চিত্র। কৃষকদের মিলিত প্রচেষ্টা ও সরকারি পরিকল্পনা উদ্যোগে সমাধানের উপায় খানিকটা করা হলো। শোষনের থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন ভারত সরকারও। দেশের  সামগ্রিক ভূমি-সংস্কারের প্রয়োজন হলো অনিবার্য। জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি ঘটল।  রচিত হলো ভূমি-সংস্কারের ব্যাপক কর্মনীতি। তবু কৃষকদের দুঃখময়-জীবনের অন্ধকার দূরীভূত হলো না। তখনও পর্যন্ত 'মাটিতে যাঁদের থেকে না চারণ ,মাটির মালিক তাঁরাই হন।' এখনও মাধ্যস্বত্বভোগী জোতদার , জমিদারের ছদ্মবেশী প্রতিনিধিরা ছলে-বলে-কৌশলে কৃষকদের অবলীলায় শোষণ করে চলেছে।  ফসলের ভাগ নিয়ে আজও জোতদার-মহাজনের সঙ্গে কৃষকদের অন্তহীন বিরোধ।  অর্থবানরা আজও আইনের আশ্রয় নেন।  তবে ভরসা কথা , কৃষকদের মধ্যেও আজ এসেছে নবজাগরণের জোয়ার।  সরকারের বৈপ্লাবিক ভূমি-সংস্কার নীতি কৃষকদের জীবনে এনেছে নতুন প্রাণপ্রবাহ। দীর্ঘকালের অত্যাচার আর অবহেলার অবসানের লগ্ন বুঝি সমাগতপ্রায়। পশ্চিমবঙ্গ আপাতদৃষ্টিতে শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্য। তবু এই দেশের শতকরা ৮০ জন মানুষ কৃষিনির্ভর।  রাজ্যের মোট আয়ের ৪২ শতাংশ কৃষিজ উৎপাদন থেকেই অর্জিত হয়।

কৃষকদের উন্নতির পথে বাঁধা :-
মান্ধাতার আমলের চাষ প্রথা , অজ্ঞতা ,পশ্চিমবাংলার কৃষকদের উন্নতির পথে আরও একটি বড় অন্তরায়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আজ বৈঞ্জানিক প্রথায় চাষ-আবাদ করে কৃষিক্ষেত্রে এনেছে বিপুল পরিবর্তন।  দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করেছে।  দারিদ্র্যকে চির-বিদায় দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজীবী মানুষের কাছে তা এতদিন ছিল অপরিঞ্জাত।  এখনও তারা যুগপ্রাচীন হাল-লাঙ্গল, কোদাল-কাস্তের যুগে বাস করছে। ধান কাটা ,ধান মাড়াই-এ আজও সেই সনাতন পদ্ধতিরই অনুবর্তন। এখনও তারা প্রকৃতি ও দৈব-নির্ভর। উন্নত সারের ব্যবহার সম্পর্কে আজও তারা অজ্ঞ। উন্নত বীজ সংগ্রহে এখনও তাদের উদাসীনতা। আজও অভাব , দারিদ্র্যের এক নিষ্করুণ চিত্র। যন্ত্রের সাহায্যে ,সমবায় প্রথায় চাষ করার প্রয়োজনীয়তা এখনও  তাদের কাছে অনধিগম্য। তার ওপর অশিক্ষার অন্ধকার। কুসংস্কারের আনুগত্য।  রোগ-মহামারীর অভিশাপ।

বাঁধা-অপসারণ কর্মসূচি :-
কৃষকদের উন্নতি ব্যাতিত কৃষিপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়।  কৃষক ও কৃষি-ব্যবস্থা দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃষ্টি। সরকার বুঝতে পেরেছেন ,গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ভিন্ন দেশের উন্নতি নেই। তাই পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা। সরকার নতুনভাবে ভূমি-সংস্কারের কর্সূচি গ্রহণ করছেন। চাষিদের হাতে জমির মালিকানা ফিরিয়ে দিয়ে চাষের জমিতে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজ চলছে। চলছে বৈঞ্জানিক প্রথায় চাষের উপযোগিতার গুরুত্ব কৃষকদের সামনে তুলে ধারার কাজ। সরকারি উদ্যোগে ও ব্যাবস্থাপনায় সার ,কীটনাশক ওষুধ ,যন্ত্রপাতি ইত্যাদির সরবরাহ কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। উত্তম সেচ-ব্যবস্থা ও বন্যা-নিরোধ প্রকল্পের কর্মসূচি গ্রহণ ,কৃষকদের জীবনকে করেছে নবীন প্রত্যয়ে উদ্বেল। দামোদর ,ময়ূরাক্ষী ,কংসাবতী ,ফরাক্কা প্রকল্পের সুবাদে নিকটবর্তী কৃষিজীবীরা ফেলেছে স্বস্তির নিশ্বাস। এছাড়াও কৃষিবিভাগ বহু ক্ষুদ্র সেচ-পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। গভীর নলকূপের্ সাহায্যে জলসেচ করা সম্ভব হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে হাসপাতাল ,স্বাথ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। স্থাপন করা হচ্ছে সমবায় প্রতিষ্ঠান। কৃষকদের অজ্ঞতা ,নিরক্ষরতা দূর করার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে শিক্ষাসম্প্রসারণ নীতি।

উপসংহার :- কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তির মেরুদন্ড , বাংলাদেশের প্রাণ। সেই প্রাণ ছিল এতকাল অনাদৃত,উপেক্ষিত। শতাব্দী ধরে এদের ওপর চলেছে নির্বিচার অত্যাচার।  মনুষ্যত্ব হয়েছে নিত্য নিগৃহীত। সেই লাঞ্ছনার দিন আজ অপগত-প্রায়। ওই শোনা যায় ,নব প্রভাতের মঙ্গল-শঙ্খধ্বনি। দিকে দিকে শুরু হয়েছে জাগরণের জোয়ার। এই মুহূর্ত মনে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রের অবিস্মরণীয় পঙতিগুলো,
                                                   "দেশের মঙ্গল ,কাহার মঙ্গল ?
                                                      তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি ,
                                                কিন্তু তুমি আমি কি দেশ ?
                                                  তুমি আমি দেশের কয় জন ?
                                                    আর এই কৃষিজীবী কয় জন ?
                                       তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয় জন থাকে ?
                                      হিসাব করিলে তাহারাই দেশ -- দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।  "
                               

                                                                        Click Here
                                               Environmental Science || পরিবেশ বিজ্ঞান 




     
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url