Ads

Hira Manik Jwale

Hira manik jwale

হীরা মানিক জ্বলে (২য় পর্ব) (উপন্যাস)





হীরা মানিক জ্বলে
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়


প্রমথ বেশ বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ যুবক। সে নিজের চেষ্টায় গ্রামে একটা নৈশ স্কুল করেছে, একটা দরিদ্র-ভান্ডার খুলেছে–তার পেছনে গ্রামের তরুণদের যে দলটি গড়ে উঠেছে– গ্রামের মঙ্গলের জন্যে তারা না করতে পারে এমন কাজ নেই। সম্প্রতি প্রমথ বাবার আড়তে বেরোতে আরম্ভ করেছে।

সুশীল বললে–প্রমথ, আমাকে তোমাদের আড়তে কাজ শেখাবে?

প্রমথ আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে চেয়ে বললে–কেন বলো তো? হঠাৎ একথা কেন তোমার মুখে?
– বসে বসে চিরকাল বাপের ভাত খাব?


তোমাদের বংশে কেউ কখনো অন্য কাজ করেনি, তাই বলছি। হঠাৎ এ মতিবুদ্ধি ঘটল কেন তোমার? সেসব বলব পরে। আপাতত একটা হিল্লে করে দাও তো।

– ওর মধ্যে কঠিন আর কী? যেদিন ইচ্ছে এসো, বাবার কাছে নিয়ে যাব।

মাস খানেক ধরে সুশীল ওদের আড়তে বেরোতে লাগল, কিন্তু ক্রমশ সে দেখলে, ভুসি মাল চালানির কাজের সঙ্গে তার অন্তরের যোগাযোগ নেই। তার বাবা ছেলেকে আড়তে যোগ দিতে বাধা দেননি, বরং বলেছিল ব্যবসার কাজে যদি কিছু টাকা দরকার হয়, তাও তিনি দেবেন।


একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন–আড়তের কাজ কীরকম হচ্ছে?

সুশীল বললে–ও ভালো লাগে না, তার চেয়ে বরং ডাক্তারি পড়ি।

– তোমার ইচ্ছে। তাহলে কলকাতায় গিয়ে দেখে-শুনে এসো।

কলকাতায় এসে সুশীল দেখলে, ডাক্তারি স্কুলে ভরতি হবার সময় এখন নয়। ওদের বছর আরম্ভ হয় জুলাই মাসে–তার এখনও তিন চার মাস দেরি।

সুশীলের এক মামা খিদিরপুরে বাসা করে থাকতেন, তাঁর বাসাতেই সুশীল এসে উঠেছিল–তাঁরই পরামর্শে সে দু-একটা অফিসে কাজের চেষ্টা করতে লাগল।


দিন-পনেরো অনেক অফিসে ঘোরাফেরা করেও সে কোথাও কোনো কাজের সুবিধে করতে পারলে না–এদিকে টাকা এল ফুরিয়ে। মামার বাসায় খাবার খরচ লাগত না অবশ্য, কিন্তু হাতখরচের জন্যে রোজ একটি টাকা দরকার। বাবার কাছে সে চাইবে না–নগদ টাকার সেখানে বড়ো টানাটানি, সে জানে। একটা কিছু না করে এবার বাড়ি ফিরবার ইচ্ছে নেই তার। অথচ করাই বা যায় কী?

সন্ধ্যার দিকে গড়ের মাঠে বসে রোজ ভাবে।

সুশীল সেদিন গড়ের মাঠের একটা নির্জন জায়গায় বসেছিল চুপ করে। বড্ড গরম পড়ে গিয়েছে–খিদিরপুরে তার মামার বাসাটিও ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের চিৎকার ও উপদ্রবে সদা সরগরম–সেখানে গিয়ে একটা ঘরে তিন-চারটি আট-দশ বছরের মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে হবে। সুশীলের ভালো লাগে না আদৌ। তাদের অবস্থা এখন খারাপ হতে পারে, কিন্তু দেশের বাড়িতে জায়গার কোনো অভাব নেই।

ওপরে নীচে বড়ো ঘর আছে–লম্বা লম্বা দালান, বারান্দা–পুকুরের ধারের দিকে বাইরের মহলে এত বড়ো একটা রোয়াক আছে যে, সেখানে অনায়াসে একটা যাত্রার আসর হতে পারে।

এমন সব জ্যোৎস্না রাতে কতদিন সে পুকুরের ধারে ওই রোয়াকটায় একা বসে কাটিয়েছে। পুকুরের ওপারে নারিকেল গাছের সারি, তার পেছনে রাধাগোবিন্দের মন্দিরের চুড়োটা, সামনের দিকে ওর ঠাকুরদাদার আমলের পুরোনো বৈঠকখানা। এ বৈঠকখানায় এখন আর কেউ বসে না–কাঠ ও বিচুলি, শুকনো তেঁতুল, ভুসি খুঁটে ইত্যাদি রাখা হয় বর্ষাকালে।


মাঝে মাঝে সাপ বেরোয় এখানে। সেবার ভাদ্র মাসে তালনবমীর ব্রতের বাহ্মণ ভোজন হচ্ছে পুজোর দালানে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শোনা গেল পুকুরপাড়ের পুরোনো বৈঠকখানার দিক থেকে। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, হরি চাকর বৈঠকখানার মধ্যে ঢুকেছিল বিচুলি পাড়বার জন্যে সেই সময় কী সাপে তাকে কামড়েছে।

হইহই হল। লোকজন এসে সারা বৈঠকখানার মালামাল বার করে সাপের খোঁজ করতে লাগল। কিছু গেল না দেখা। হরি চাকর বললে সে সাপ দেখেনি, বিচুলির মধ্যে থেকে তাকে কামড়েছে।

ওঝার জন্যে রানীনগরে খবর গেল। রানীনগরের সাপের ওঝা তিনটে জেলার মধ্যে বিখ্যাত–তারা এসে ঝাড়ফুঁক করে হরিকে সে-যাত্রা বাঁচালে।

লোকজনে খুঁজে সাপও বের করলে–প্রকান্ড খয়ে-গোখরো। হরি যে বেঁচে গেল, তার পুনর্জন্ম বলতে হবে। – বাবু, ম্যাচিস আছে–ম্যাচিস?


সুশীল চমকে মাথা তুলে দেখলে, একটি কালোমতো লোক। অন্ধকারে ভালো দেখা গেল না। নিম্নশ্রেণির অশিক্ষিত অবাঙালি লোক বলেই সুশীলের ধারণা হল–কারণ তারাই সাধারণত দেশলাইকে ম্যাচিস বলে থাকে।

সুশীল ধূমপান করে না, সুতরাং সে দেশলাইও রাখে না। সে-কথা লোকটাকে বলতে সে চলেই যাচ্ছিল–কিন্তু খানিকটা গিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যে যেন কী ভেবে ফিরে এল।

সুশীলের একটু ভয় হল। লোকটিকে এবার সে ভালো করে দেখে নিয়েছে অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে। বেশ সবল, শক্ত-হাত-পা-ওয়ালা চেহারা–গুণ্ডা হওয়া বিচিত্র নয়। সুশীলের পকেটে বিশেষ কিছু নেই–টাকা-তিনেক মাত্র। সুশীল একটু সতর্ক হয়ে সরে বসল। লোকটা ওর কাছে এসে বিনীত সুরে বললে–বাবুজি, দু-আনা পয়সা হবে? সুশীল বিনা বাক্যব্যয়ে একটা দু-আনি পকেট থেকে বের করে লোকটার হাতে দিলে। তাই নিয়ে যদি খুশি হয়, হোক না। এখন ও চলে গেলে যে হয়!

চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ কিন্তু লোকটার মধ্যে দেখা গেল না। সে সুশীলের কাছেই এসে সকৃতজ্ঞ সুরে বললে–বহুৎ মেহেরবানি আপনার বাবু! আমার আজ খাওয়ার কিছু ছিল না–এই পয়সা লিয়ে হুটেলে গিয়ে রোটি খাব। বাবুজির ঘর কুথায়?


ভালো বিপদ দেখা যাচ্ছে! পয়সা পেয়ে তবুও নড়ে না যে! নিশ্চয় আরও কিছু পাবার মতলব আছে ওর মনে মনে। সুশীল চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলে, কাছাকাছি কেউ নেই। পকেটে টাকা তিনটে ছাড়া সোনার বোতামও আছে জামায়, হঠাৎ এখন মনে পড়ল।

ও উত্তর দিলে–কলকাতাতেই বাড়ি, বালিগঞ্জে। আমার কাকা পুলিশে কাজ করেন কিনা, এদিকে রোজ বেড়াতে আসেন মোটর নিয়ে। এতক্ষণে এলেন বলে, রেড রোডে মোটর রেখে এখানেই আসবেন। আমি এখানে থাকি রোজ, উনি জানেন। বেশ বাবু, আপনাকে দেখেই বড়ো ঘরানা বলে মনে হয়।

সুশীলের মনে কৌতূহল হওয়াতে সে বললে–তুমি কোথায় থাক?

– মেটেবুরুজে বাবুজি। – কিছু কর নাকি?


– জাহাজে কাজ করতাম, এখন কাজ নেই। ঘুরি-ফিরি কাজের খোঁজে। রোটির জোগাড় করতে হবে তো? লোকটার সম্বন্ধে সুশীলের কৌতূহল আরও বেড়ে উঠল। তা ছাড়া লোকটার কথাবার্তার ধরনে মনে হয় লোকটা খুব খারাপ ধরনের নয় হয়তো। সুশীল বললে–জাহাজে কতদিন খালাসিগিরি করছ?

– দশ বছরের কুছু ওপর হবে।

– কোন কোন দেশে গিয়েছ?

– সব দেশে। যে দেশে বলবেন সে দেশে। জাপান লাইন, বিলেত লাইন, জাভা-সুমাত্রার লাইন–এস এস পেনগুইন, এস এস গোলকুন্ডা–এস এস নলডেরা, পিয়েনোর বড়ো জাহাজ নলডেরা, নাম শুনেছেন?

'পিয়েনো' কী জিনিস, পল্লিগ্রামের সুশীল তা বুঝতে পারলে না। না, ওসব নাম সে শোনেনি।

– তা বাবুজি, আপনার কাছে ছিপাব না। সরাব পিয়ে পিয়ে কাজটা খারাবি হয়ে পড়ল, জাহাজ থেকে ডিসচার্জ করে দিলে। এখন এই কোষ্টো যাচ্ছে, মুখ ফুটে কাউকে বলতে ভি পারিনি। কী করব, নসিব বাবুজি! – জাহাজের কাজ আবার পাবে না?


– পাব বাবুজি, ডিসচার্জ সাটিক-ফিটিক ভালো আছে। সরাব টরাবের কথা ওতে কুছু নেই। কাপ্তানটা ভালো লোক, তাকে কেঁদে গোড়-পাকড়ে বললাম–সাহেব আমার রোটি মেরো না। ওকথা লিখো না! লোকটি আর-একটু কাছে এসে ঘেঁষে বসল। বললে–আমার নসিব খারাপ বাবু–নয় তো আমায় আজ চাকরি করে খেতে হবে কেন? আজ তো আমি রাজা!

সুশীল মৃদু কৌতূহলের সুরে জিজ্ঞাসা করলে–কীরকম?

লোকটি এদিক-ওদিক চেয়ে সুর নামিয়ে বললে–আজ আর বলব না। এইখানে কাল আপনি আসতে পারবেন?

– কেন পারব না?

– তাই আসবেন কাল। আচ্ছা বাবু, আপনি পুরোনো লিখা পড়তে পারেন?

সুশীল একটু আশ্চর্য হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে বললে–কী লেখা?

– সে কাল বাৎলাবো। আপনি কাল এখানে আসবেন, তবে, বেলা থাকতে আসবেন–সুর ডুববার আগে। মামার বাসায় এসে কৌতূহলে সুশীলের রাতে চোখে ঘুমই এল না। এক-একবার তার মনে হল, জাহাজি মাল্লা কত দূর কত দেশ ঘুরেছে, কোনো এক আশ্চর্য ব্যাপারের কথা কি তাকে বলবে? কেননা নতুন দেশের কথা? পুরোনো লেখা কীসের?... ওর ছোটো মামাতো ভাই সনৎ ওর পাশেই শোয়। গরমে তারও চোখে ঘুম নেই। খানিকটা উশখুশ করার পরে সে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বাললে। বললে–দাদা চা খাবে? চা করব? – এত রাত্তিরে চা কী রে?


– কী করি বল। ঘুম আসছে না চোখে–খাও একটু চা। সনৎ ছেলেটিকে সুশীল খুব পছন্দ করে। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, লেখা-পড়াতেও ভালো, ফুটবল খেলায় এরই মধ্যে বেশ নাম করেছে, কলেজ টিমের বড়ো বড়ো ম্যাচে খেলবার সময় ওকে ভিন্ন চলে না।

সনৎ-এর আর একটা গুণ, ভয় বলে কোনো জিনিস নেই তার শরীরে। মনে হয় দুনিয়ার কোনো কিছুকে সে গ্রাহ্য করে না। দু-বার এই স্বভাবের দোষে তাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল, একবার খেলার মাঠে এক সার্জেন্টের সঙ্গে মারামারি করে, নিজে তাতে মার খেয়েছিলও খুব – মার দিয়েছিলও। সেবার ওর বাবা টাকাকড়ি খরচ করে ওকে জেলের দরজা থেকে ফিরিয়ে আনেন। আর একবার মাহেশের রথতলায় একটি মেয়েকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে গুন্ডার ছুরিতে প্রায় প্রাণ দিয়েছিল আর-কী। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক যুবকদল ওকে গুণ্ডাদের মাঝখান থেকে টেনে উদ্ধার করে আনে।


যদি তোমাদের এগুলো ভালো লাগে তাহলে কোমান্ড কর আর শেয়ার কর। তাহলে আমি আরও লিখব তোমাদের জন্য ।


ধন্যবাদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url