Sinking Boat || নৌকাডুবি
নৌকাডুবি
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
![]() |
Sinking Boat || নৌকাডুবি |
Sinking Boat || নৌকাডুবি |
রমেশ এবার আইন-পরীক্ষায় যে পাস্ হইবে , সে সম্বন্ধে কাহারো কোনো সন্দেহ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতী বরাবর তাঁহার স্বর্ণপদ্মের পাপড়ি খসাইয়া রামেশকে মেডেল দিয়া আসিয়াছেন --স্কলারশিপও কখনো ফাঁক যায় নাই।
পরীক্ষা শেষ করিয়া এখন তাহার বাড়ি যাইবার কথা। কিন্তু এখনো তাহার তোরঙ্গ সাজাইবার কোনো উৎসাহ দেখা যায় নাই। পিত শীঘ্র বাড়ি আসিবার জন্য পত্র লিখিয়াছেন। রমেশ উত্তরে লিখিয়াছে, পরীক্ষায় ফল বাহির হইলেই সে বাড়ি যাইবে।
অন্নদাবাবুর ছেলে যোগেন্দ্র রমেশের সহাধ্যায়ী। পাশের বাড়িতেই সে থাকে। আনন্দবাবু ব্রাক্ষ। তাঁহার কন্যা হেমনলিনী এবার এফ. এ. দিয়েছে। রমেশ আনন্দবাবুর বাড়ি চা খাইতে এবং চা না খাইতেও প্রায়ই যাইত।
হেমনলিনী স্নানের পার চুল শুকাইতে ছাদে বেড়াইয়া পড়া মুখস্থ করিত। রমেশও সেই সময়ে বাসার নির্জন ছাদে চিলেকোঠার এক পাশে বি লইয়া বসিত। অধ্যয়নের পক্ষে এরূপ স্থান অনুকূল বটে, কিন্তু একটু চিন্তা করিয়া দেখিলেই বুঝিতে বিলম্ব হইবে না যে , ব্যাঘাত যথেষ্ট ছিল।
এ পর্যন্ত বিবাহ সম্বন্ধে কোনো পক্ষ হইতে কোনো প্রস্তাব হয় নাই। অন্নদাবাবুর দিক হিতে না হইবার একটু কারণ ছিল। একটি ছেলে বিলাতে ব্যারিস্টার হইবার জন্য গেছে , তাহার প্রতি অন্নদাবাবুর মানে মানে লক্ষ আছে।
সেদিন চায়ের টেবিলে খুব একটা তর্ক উঠিয়াছিল। অক্ষয় ছেলেটি বেশি পাস্ করিতে পারে নাই। কিন্তু তাই বলিয়া সে- বেচারার চা-পানের এবং অন্যান্য শ্রেণীর তৃষা পাস্-করা ছেলেদের চেয়ে কিছু কম ছিল তাহা নহে। সুতরাং হেমনলিনীর চায়ের টেবিলে তাহাকেও মাঝে মাঝে দেখা যাইত। সে তর্ক তুলিয়াছিল যে , পুরুষের বুদ্ধি খড়েগর মতো ,শান বেশি না দিলেও কেবল ভারে অনেক কাজ করিতে পারে ; মেয়েদের বুদ্ধি কলমকাটা ছুরির মতো , যতই ধার দাও-না কেন , তাহাতে কোনো বৃহৎ কাজ চলে না -ইত্যাদি। হেমলিনী অক্ষয়ের এই প্রগলভতা নীরবে উপেক্ষা করিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু স্ত্রীবুদ্ধিকে খাটো করিবার পক্ষে তাহার ভাই যোগেন্দ্রও যুক্তি আনয়ন করিল। তখন রমেশকে আর ঠেকাইয়া রাখা গেল না। সে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া স্ত্রী জাতির সবাবগন করিতে আরম্ভ করিল।
এইরূপ রমেশ যখন নারীভক্তির উচ্ছ্বসিত উৎসাহে অন্যদিনের চেয়ে দু পেয়ালা চা বেশি খাইয়া ফেলিয়াছে , এমন সময় বেহারা তাহার একটুকরা চিঠি দিল। বহির্ভাগে তাহার পিতার হস্তাক্ষরে তাহার নাম লেখা। চিঠি পড়িয়া তর্কের মাঝখানে ভঙ্গ দিয়া রমেশ শশব্যস্তে উঠিয়া পড়িল। সকলে জিজ্ঞাসা করিল , "ব্যাপারটা কি?" রমেশ কহিল , "বাবা দেশ হইতে আসিয়াছেন। "হেমনলিনী যোগেন্দ্রকে কহিল , "দাদা , রামেসবাবুর বাবাকে এইখানেই ডাকিয়া যান-না কেন, এখানে চায়ের সমস্ত প্রস্তুত আছে।"
লইবার ব্যবস্হা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বিবাহের পর সকলে মিলিয়ে একসঙ্গে যাত্রা করাই তাঁহার ইচ্ছা। এইজন্য তিনি বাড়ি হইতে আত্মীয় স্ত্রীলোক কয়েকজনকে সঙ্গেই আনিয়াছিলেন।
বিবাহকালে রমেশ ঠিকমত মন্ত্র আবৃত্তি করিল না , শুভদৃষ্টির সময় চোখ বুজিয়া রহিল , বাসরঘরের হাস্যোৎপাত নীরবে নতমুখে সহ্য করিল , রাত্রে শয্যাপ্রান্তে পাশ ফিরিয়া রহিল , প্ৰত্যুষে বিছানা হইতে উঠিয়া বাহিরে চলিয়া গেল।
বিবাহ সম্পন্ন হইলে মেয়েরা এক নৌকায় , বৃদ্ধেরা এক নৌকায় , বার ও বয়স্যগণ আর - এক নৌকায় যাত্রা করিল। অন্য এক নৌকায় রোশনচৌকির দল যখন- তখন যে- সে রাগিনী যেমন-তেমন ক্রিয়া আলাপ করিতে লাগিল।
সমস্ত দিন অসহ্য গরম। একাডে মেঘ নাই , অথচ একটা বিবর্ন আচ্ছাদনে চারিদিক ঢাকা পড়িয়াছে -- তীরের তরুশ্রেণী পাংশুবর্ণ। গাছের পাতা নড়িতেছে না। দাঁড়িমাঝিরা গলদঘর্ম। সন্ধ্যার অন্ধকার জমিবার পূর্বেই মাল্লারা কাহিল ,"কর্তা , নৌকা এইবার ঘটে বাঁধি - সম্মুখে অনেকদূর আর নৌকা রাখিবার জায়গা নাই।" ব্রজমোহনবাবু পথে বিলম্ব করিতে চান না। তিনি কহিলেন , "এখানে বাঁধিলে চলিবে না। আজ প্রথম রাত্রে জ্যোৎস্না আছে , আজ বালুহাটে পৌঁছিয়া নৌকা বাঁধিব। তোরা বকশিশ পাইবি।"
নৌকা গ্রাম ছাড়াইয়া চলিয়া গেল। এক দিকে চর ধূ ধূ করিতেছে , আর -এক দিকে ভাঙা উচ্চ পাড়। কুহেলিকার মধ্যে চাঁদ উঠিল , কিন্তু তাহাকে মাতালের চক্ষুর মতো অত্যন্ত ঘোলা দেখিতে লাগিল।
এমন সময় আকাশে মেঘ নাই , কিছু নাই , অথচ কথা হইতে একটা গর্জন ধ্বনি ধোন গেল। পশ্চাতে দিগন্তের দিকে চাহিয়া দেখা গেল ,একটা প্রকান্ড অদৃশ্য সম্মার্জনী ভাঙা ডাল পালা , খড়কুটা , ধূলা-বালি একাডে উড়িয়া প্রকান্ড বেগে ছুটিয়া আসিতেছে ; 'রাখ রাখ , সামাল সামাল , হয় হয় ' করিতে করিতে মুহূর্তকাল পরে কি হইল , কেহই বলিতে পারিল না। একটা ঘূর্ণা হাওয়া একটি সংকীর্ণ পথ মাত্র আশ্রয় করিয়া প্রবলবেগে সমস্ত উন্মূলিত বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া নৌকা-কয়টাকে কোথায় কি করিল ,তাহার কোনো উদ্দেশ পাওয়া গেল না।